রোজায় খাদ্যাভ্যাস ও করণীয়

 ইসলামের জীবন ব্যবস্থায় পাঁচটি স্তম্ভ রয়েছে, তার মধ্যে রমজান মাসের রোজা অন্যতম। সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক সব মুসলমানের জন্য রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হয়েছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উপবাসের নিয়ত করে সুবেহ সাদিক থেকে সূর্যাস্ত্ত পর্যন্ত পানাহার ও সব ধরনের ইন্দ্রিয় তৃপ্তিকর কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার নাম রোজা। রমজান মাসে আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য অফুরন্ত রহমত, বরকত, মাগফিরাত, নাজাত ও ফজিলত দান করেন। রমজান মাসের রোজার ফজিলত বর্ণনা করে শেষ করা যায় না। হুজুর পাক (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে ঈমানের সঙ্গে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতের কল্যাণ লাভের আশায় রোজা পালন করবে, আল্লাহ তায়ালা তার আগের সব সগিরা গোনাহ মাফ করে দেবেন।’ রমজানের রোজা রোজাদারের জন্য ঢালস্বরূপ। যদি না রোজাদার মিথ্যা কথা কিংবা কোনো গিবত দ্বারা রোজা নষ্ট করে না ফেলে। আল্লাহপাকই প্রতিটি রোজাদারের প্রতিদান দেবেন। রমজানের রোজার উদ্দেশ্য হলো মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে শয়তানের সব প্ররোচনা ও নফ্সকে দমন করা। তাই রোজা দেহ ও অন্তরকে বিশুদ্ধ করার অন্যতম শর্ত শরিয়তের বিধান অনুযায়ী হালাল উর্পাজন ও হালাল মাল দ্বারা জীবন যাপন করা।
আমাদের দেশে রমজান মাস এলেই খাওয়া-দাওয়ার ধুম পড়ে যায়। মানুষ অস্থির হয়ে পড়ে কী খাবে, কী খাবে না। আসলে সারা পৃথিবীতে মুসলমানরা ইসলামের বিধান অনুযায়ী একই নিয়মে রোজা পালন করেন। বিভিন্ন দেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এবং বিভিন্ন রকম খাওয়া-দাওয়ার অভ্যাস রয়েছে। তাই স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বিভিন্ন রকম খাওয়া-দাওয়ারও তারতম্য রয়েছে। এ অবস্থায় এই আলোচনায় আমাদের দেশের মানুষের যে ধরনের খাদ্যাভ্যাস রয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করব। প্রথমে সুস্থ মানুষের জন্য কী কী খাবার খাওয়া উচিত সেই দিক নিয়ে আলোকপাত করব।

ইফতারিতে কী কী খাবেন?
রমজান মাস এলে বিকাল বেলা থেকেই ইফতারের জন্য নানা খাবার তৈরি ও বিক্রির হিড়িক পড়ে। হরেক রকম ইফতারির পসরা সাজিয়ে দোকানিরা রাস্তার ধারে ফুটপাতে, অলিতে-গলিতে, হাটে-বাজারে বসে যায়। এসব ইফতারির মধ্যে রয়েছে ছোলা, মুড়ি, পেঁয়াজু, বেগুনি, ডালবরা, সবজি বরা, আলুর চপ, খোলা খেজুর, হালিম, জালি কাবাব, জিলাপি, বুইন্দা ইত্যাদি। আরও রয়েছে বিভিন্ন ফল ও ফলের রস, আখের গুড়ের শরবত, নানা রংমিশ্রিত বাহারি শরবত। তাছাড়া মুখরোচক বিরিয়ানি ও তেহারি তো আছেই।
এখন প্রশ্ন হলো—এসব মুখরোচক খাবার স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে তৈরি করা হয়েছে কিনা? ভেজাল তেল, বেসন ও কৃত্রিম রং মেশানো হয়েছে কিনা সেদিকে নজর দেয়া উচিত। যে তেলে ভাজা হয় সেই তেল একবারের বেশি ব্যবহার উচিত নয়। কারণ একই তেল বার বার আগুনে ফুটালে কয়েক ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য তৈরি হয়। যেমন—একই তেল বার বার ব্যবহৃত হলে তা থেকে পলি নিউক্লিয়ার হাইড্রোকার্বন তৈরি হয়। যার মধ্যে বেনজা পাইরিন নামক ক্যান্সার হতে পারে এমন পদার্থের মাত্রা বেশি থাকে। তাছাড়া অপরিষ্কারভাবে ইফতারি তৈরি করলে পেটের পীড়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সুস্থভাবে বাঁচার জন্য যত্রতত্র খোলা খাবার না খাওয়াই উচিত।
খুব কম ফলই পাওয়া যাবে যা ভেজালমুক্ত। শরবতের কথা তো বলাই বাহুল্য। রাস্তা-ঘাটে, হাটে-বাজারে রকমারি শরবত তৈরি করা হয়। আমাদের জানতে হবে, এসব শরবত যে পানি দিয়ে বানানো হয় সে পানি বিশুদ্ধ কি-না। তাছাড়া ইফতারের জন্য তৈরি প্রায় সব খাবার তেল ও উচ্চ চর্বিযুক্ত। সাধারণত অধিক মুনাফার আশায় এসব খাবার মানসম্মত তেলে এবং সঠিক নিয়মে ভাজা হয় না, তাই এসব স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
একজন রোজাদার ইফতারে কী খাবেন তা নির্ভর করবে তার স্বাস্থ্যের অবস্থা ও বয়সের ওপর। এখানে উল্লেখ্য যে, পারতপক্ষে দোকানের তৈরি ইফতারি ও সাহরি না খাওয়াই ভালো। সুস্থ স্বাস্থ্যবান রোজাদারের জন্য ইফতারিতে খেজুর বা খুরমা, ঘরের তৈরি বিশুদ্ধ শরবত, কচি শসা, পেঁয়াজু, বুট, ফরমালিন অথবা ক্যালসিয়াম কার্বাইডমুক্ত মৌসুমি ফল থাকা ভালো। কারণ ফলে ভিটামিন ও মিনারেল পাওয়া যায়। ফল খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয় এবং সহজে তা হজম হয়। রুচি অনুযায়ী বাসার রান্না করা নুডুলসও খেতে পারেন। বেশি ভাজি ভূনা তেহারি, হালিম না খাওয়াই ভালো। কারণ এতে বদহজম হতে পারে। রুচি পরিবর্তনের জন্য দু-একটা জিলাপি খেতে পারেন। তাছাড়া গ্রীষ্মকালীন রমজানে পরিমাণমতো বিশুদ্ধ পানি পান করা উচিত।
অতঃপর এশা ও তারাবির নামাজের পর অভ্যাস অনুযায়ী পরিমাণমত ভাত, মাছ অথবা মুরগির মাংস, ডাল ও সবজি খাবেন।

সাহরিতে কী খাবেন?
সুবহে সাদিকের আগে যে খাবার খাওয়া হয় তাকে সাহরি বলে। সাহরি খাওয়া অবশ্যই কর্তব্য, এটা হুজুর পাক (সা.)-এর নির্দেশ। রমজানে বছরে একটি মাসে বাকি এগারো মাসের স্বাভাবিক নিয়ম পরিবর্তন করে সুবহে সাদিকের আগে ঘুম থেকে উঠে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিতে হয়। সাধারণ নিয়মে সকালের নাস্তার পরিবর্তে খুব ভোরে সারাদিনের উপবাসের সময় চলার মতো খাওয়ার প্রয়োজন হয়। শরীরটাকে সুস্থ রাখার জন্য সাহরি খাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে অভ্যাস করে নিলে আমাদের শরীরের যন্ত্রাংশগুলোও স্বাভাবিক প্রকৃতিতে এক মাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। মনে রাখতে হবে, সাহরির খাবার মুখরোচক, সহজ পাচ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত হওয়া প্রয়োজন। অধিক তেল, অধিক ঝাল, অধিক চর্বিজাতীয় খাবার খাওয়া একদম উচিত নয়। ভাতের সঙ্গে মিশ্র সবজি, মাছ অথবা মাংস অথবা ডিম থাকা প্রয়োজনীয়। ডালও থাকতে পারে। আমাদের পাকস্থলীতে অধিক উত্তেজনা কিংবা অস্বস্তি সৃষ্টি করে এমন খাবার খাওয়া সঠিক নয়। তার কারণ গুরুপাক খাবার খেলে শরীরের বিপাকক্রিয়া বেড়ে যায়। অধিক চর্বিজাতীয় খাবার খেলে রোজাকালীন শরীর অসুস্থ লাগতে পারে, ক্লান্তি কিংবা ঘুম আসতে পারে। পিপাসা নিবারণ হয় সেই পরিমাণ পানি নিজের অভ্যাস অনুযায়ী পান করতে হবে। মেদবহুল মোটা মানুষের জন্য রমজান মাস ওজন কমানোর জন্য সুবর্ণ সুযোগ। এই সুযোগ অবশ্যই গ্রহণ করা উচিত। যারা ধূমপানে অভ্যস্ত, রমজানই ধূমপান ছাড়ার উপযুক্ত সময়।

লিভার আক্রান্ত রোগীর রোজা
লিভারের অসুখে আক্রান্ত রোগীর রোজা রাখা উচিত কি-না তা নির্ভর করবে তিনি কী ধরনের লিভার রোগে আক্রান্ত আছেন তার ওপর ভিত্তি করে। ধরা যাক, কেউ যদি জন্ডিসে আক্রান্ত থাকেন, যার অন্যতম কারণ ভাইরাল হেপাটাইটিস। এ ধরনের জন্ডিস সারা বছর ধরে ঘরে ঘরে দেখা যায়। শুষ্ক মৌসুমে কিংবা বন্যা-পরবর্তী মৌসুমে আমাদের দেশে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি ঘটে। ভাইরাল হেপাটাইটিস হলে বেশিরভাগ সময় রোগীর ক্ষুধামন্দা হয়, বমি কিংবা বমি বমি ভাব থাকে কিংবা শরীর অসুস্থ বোধ হয় কিংবা নিস্তেজ মনে হয়। এ উপসর্গগুলো তীব্র হলে ও জন্ডিসের মাত্রা বেশি হলে রোগীকে তখন শিরার মাধ্যমে স্যালাইন দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে। শরীর দুর্বল থাকে তাই এ অবস্থায় রোজা রাখা বাঞ্ছনীয় নয়। সুস্থ হলে পরবর্তী সময়ে ফরজ রোজা আদায় করে নিতে হবে। দ্বিতীয় যে লিভারের রোগ আমাদের দেশে দেখা যায় তার নাম লিভার সিরোসিস। সিরোসিস রোগী দু’ভাবে উপসর্গ নিয়ে চিকিত্সকের শরণাপন্ন হয়। প্রথমত, খাওয়ার প্রতি অনীহা, পেটের পীড়া, আমাশয় অথবা ডায়রিয়া নিয়ে আসতে পারে। এই সময়ে রোগের উপসর্গের মাত্রা যদি কম থাকে সাধ্যমত খেতে পারে, খাওয়া হজম হয় তাহলে ফরজ রোজা রাখার চেষ্টা করা অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু যদি দ্বিতীয় পর্যায় যখন পেটে পানি জমে, পায়ে পানি জমে, তখন পানি নিসরনের জন্য যাদের উরঁত্বঃরপং খেতে হয়, তাদের পানি পিপাসা বৃদ্ধি পেতে পারে। তাছাড়া রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে রোজা রাখলে জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে বিধায় শরিয়ত মোতাবেক তাদের রোজার কাফ্ফারা দিতে হবে। তাদের রোজা রাখার মতো শরীরের অবস্থা থাকে না।
দ্বিতীয়ত, লিভারের অ্যাডভান্স ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর পক্ষে রমজানের ফরজ রোজা আদায় করা সম্ভব নাও হতে পারে। কারণ তিনি তখন গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ব্যথা-বেদনায় ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, অভুক্ত অবস্থায় থাকেন। তার আত্মীয়রাই তার পক্ষ থেকে তার রোজার কাফ্ফারা দেয়ার ব্যবস্থা করবেন।

পেপটিক আলসার রোগীর রোজা
এই রোগে যাদের খালি পেটের উপরিভাগে জ্বালা বোধ হয়, বুক জ্বলে কিংবা চুকা (টক) ঢেঁকুর আসে কিংবা শেষ রাতে পেটের ব্যথায় ঘুম ভেঙে যায়—ধরে নিতে হবে তাদের পেপটিক আলসার রয়েছে। সেক্ষেত্রে এইচটু ব্লকার কিংবা প্রোটন পাম্প ইনহিভিটর জাতীয় ওষুধ খেলে যদি ব্যথা সেরে যায়, ওষুধ খাওয়ার পর ইফতার ও সাহরির সময় যদি শারীরিক অসুবিধা না থাকে তাহলে রমজানের রোজা পালন করতে পারেন। কিন্তু যদি রোগ উপশম না হয় বা জীবনে কোনো না কোনো সময়ে রক্ত বমি কিংবা কালো পায়খানা হয়ে থাকে, তাহলে রোজা রাখার আগে তাদের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে হবে।

হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ রোগীর রোজা
হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীর ক্ষেত্রে সাধারণত রোজা রাখার বিধিনিষেধ নেই। তবে যেসব রোগীর ‘অ্যাকিউট মায়োকার্ডিয়াল ইনফারকশন’ হয়েছে কিংবা হার্টফেইলুর আছে কিংবা হার্টের রিদমে গণ্ডগোল আছে কিংবা হার্টফেইলুরের কারণে শ্বাসকষ্ট হয়ে যারা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন তাদের অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী নিজ নিজ স্বাস্থ্যের অবস্থার প্রেক্ষাপটে ব্যবস্থা নিতে হবে।

হাঁপানি রোগীর রোজা
অ্যাজমা রোগে যারা আক্রান্ত আছেন, যাদের ট্যাবলেট কিংবা ইনহেলার নিলে শ্বাসকষ্ট দূর হয়ে যায়, তাদের ক্ষেত্রে রোজা রাখার কোনো বাধা-নিষেধ নেই। শুধু ইফতার কিংবা সাহরির সময় ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। যেসব রোগী তীব্র শ্বাসকষ্টে ভোগেন এবং দিনে কয়েকবার ইনহেলার কিংবা ওষুধ খেতে হয় তাদের পক্ষে রোজা পালন করা সম্ভব নয়। তাদের পরবর্তী সময়ে কাফ্ফারা দিতে হবে।

ডায়াবেটিক রোগীর রোজা
ডায়াবেটিস হলে রোগী রোজা রাখতে পারবে না এ কথা সঠিক নয়। কারণ ডায়াবেটিক রোগীকে রোজা রাখার আগে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী মুখে খাবার ওষুধ অথবা ইনসুলিন এবং খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ নিয়ে রোজা শুরু করা উচিত। কারণ ডায়াবেটিক রোগীরা রক্তের সুগারের স্বল্পতা কিংবা আধিক্য, ডায়াবেটিক কিটো এসিডোসিস কিংবা পানিশূন্যতায় ভুগতে পারেন। এখানে উল্লেখ্য, যেসব ডায়াবেটিক রোগী শুধু খাবার ও ব্যায়ামের মাধ্যমে রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখেন তাদের রোজা রাখলে সমস্যা ও ঝুঁকি কম। তাছাড়া যারা মেটফরমিন অথবা গ্লিটাজোনস্ জাতীয় ওষুধ খান তাদেরও সমস্যার সম্ভাবনা কম। কিন্তু সাবধান হতে হবে যারা সালফুনাইল ইউরিয়া ও ইনসুলিন নিয়ে থাকেন। তাই ডায়াবেটিক রোগীদের রমজান মাসের দুই তিন মাস আগে থেকেই বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী পথ্য ও ওষুধ সম্পর্কে পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। ডায়াবেটিস জীবনে শৃঙ্খলাবোধ সৃষ্টি করে। খাবারের শৃঙ্খলা, জীবন যাপনের শৃঙ্খলা ও নৈতিক শৃঙ্খলা সবই ডায়াবেটিক রোগীরা শিক্ষা লাভ করে। যারা বৃটল ডায়াবেটিসে ভোগেন তারা অস্থিতিশীল অবস্থায় থাকেন। সেক্ষেত্রে রোজা না রাখাই শ্রেয়। যারা সচরাচর কোষ্ঠকাঠিন্য রোগে ভোগেন তারা ইফতারির সময় সালাদ, ফলের রস কিংবা ইসপগুলের ভুষি ও খাবারের সময় পর্যাপ্ত সবজি খাবেন।

Leave a comment