ট্যাক্স ক্যালকুলেটর কী?
বাংলাদেশি করদাতাদের জন্য তৈরি বিশেষ অনলাইন সফটওয়্যার ট্যাক্স ক্যালকুলেটর। এতে নিজের বার্ষিক আয়কর সহজে হিসাব করে নেওয়া যায়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইটে (www.nbr-bd.org) এ ক্যালকুলেটরটি রয়েছে। নির্দিষ্ট ঘরে প্রয়োজনীয় উপাত্ত বসালেই সফটওয়্যারটি মোট আয় ও আয়ের ওপর প্রদেয় কর জানিয়ে দেবে। এ জন্য আয়কর সম্পর্কিত আইন ও বিধি বিস্তারিত জানার তেমন প্রয়োজন নেই।
২০১১ সালের আয়কর মেলায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রথম ট্যাক্স ক্যালকুলেটরকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে পরিচালিত ‘অ্যাক্সসে টু ইনফরমেশন’ (সংক্ষেপে এটুআই) প্রকল্পের উদ্যোগে সফটওয়্যারটি তৈরি করা হয়। এটি তৈরিতে কারিগরি সহায়তা দেয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান টেকনো ভিস্তা ও ট্যাক্সমেট বিডি। এ উদ্যোগের জন্য ২০১১ সালে এনবিআরকে জাতীয় ডিজিটাল উদ্ভাবনী পুরস্কার দেওয়া হয়।
কাদের জন্য এই ক্যালকুলেটর
কোনো ব্যক্তির বার্ষিক আয় যদি দুই লাখ টাকার বেশি হয়, তাহলে তাঁকে আয়কর দিতে হবে। নবীন করদাতা থেকে শুরু করে প্রবীণ করদাতা, যে কেউ বার্ষিক কর নিরূপণ ও আয়কর রিটার্ন তৈরির জন্য ট্যাক্স ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে পারেন। ব্যক্তি আয়কর কিংবা কম্পানি আয়কর_দুই ধরনের করই এ ক্যালকুলেটর দিয়ে হিসাব করা যাবে। এ জন্য শুধু ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই হবে।
যেভাবে ব্যবহার করতে হবে
রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইট http://www.nbr-bd.org -এ প্রবেশ করলেই ট্যাক্স ক্যালকুলেটরের লিঙ্ক পাওয়া যাবে। আবার http://www.nbrtaxcalculatorbd.org থেকেও সরাসরি ক্যালকুলেটরটি ব্যবহার করা যাবে। এখানে দুটি ট্যাবে রয়েছে_ট্যাক্স ক্যালকুলেটর ও ট্যাক্স রিটার্ন প্রিপারেশন। রিটার্ন প্রিপারেশন সফটওয়্যারটি ক্যালকুলেটরেরই বর্ধিত রূপ। এটি ব্যবহার করে কর হিসাব করার পাশাপাশি নির্ভুলভাবে রিটার্ন তৈরি করা যাবে।
ব্যক্তি আয়কর হিসাব করতে চাইলে Individual Tax Calculator এবং প্রতিষ্ঠানের আয়কর হিসাব করতে চাইলে Company Tax Calculator নির্বাচন করতে হবে। এরপর প্রাথমিক তথ্য, যেমন- নাম, জন্ম তারিখ, টিআইএন নম্বর ইত্যাদি ঘর পূরণ করতে হবে।
ব্যক্তি আয়করের ক্যালকুলেটরের ছকে ৯টি খাত রয়েছে। এগুলো হলো_ বেতন, সিকিউরিটি সুদ, বাড়ি ভাড়া, কৃষি, ব্যবসা বা পেশা, ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা হিসেবে প্রাপ্ত লভ্যাংশ, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানের আয়, মূলধনী মুনাফা ও অন্যান্য খাতের আয়। প্রতিটি খাতে বার্ষিক আয়ের পরিমাণ বসানোর পর নিচের Total Income ও Tax Leviable Total Income ঘরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মোট আয় ও তার ওপর প্রদেয় আয়কর চলে আসবে। এসব আয়ের মধ্যে কোনো কর রেয়াত থাকলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাদ হয়ে যাবে। যেমন_পেনশনের আয় করমুক্ত হওয়ায় এর ওপর কর দিতে হবে না। এ ছাড়া বিনিয়োগজনিত আয়কর রেয়াতের পরিমাণ জানতে চাইলে Investments ঘরে বিনিয়োগের পরিমাণ উল্লেখ করতে হবে। কম্পানির বার্ষিক আয় ও আয়কর হিসাব করতে চাইলে এর জন্য নির্ধারিত ফরমটি পূরণ করতে হবে। এরপর সফটওয়্যার স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানিয়ে দেবে মোট আয় ও তার ওপর প্রদেয় কর। হিসাব-নিকাশ শেষ করার পর Print-এ ক্লিক করে নিয়ে রিটার্নের সঙ্গে এটি সংযুক্ত করতে হবে।
আয়কর হিসাবের পাশাপাশি যদি অনলাইনে রিটার্নও প্রস্তুত করতে চান, তাহলে আপনাকে নিবন্ধিত ইউজার হতে হবে। এর জন্য সাইটের হোমপেইজ থেকে নিবন্ধন করে লগ-ইন করুন। এবার রিটার্ন প্রিপারেশনের পৃষ্ঠা দেখতে পাবেন। এগুলো পূরণ করে Save বাটনে ক্লিক করে পরবর্তী সময়ে সংশোধন বা পরিমার্জনের জন্য সংরক্ষণ করে রাখতে পারবেন।
প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠুভাবে জানার জন্য এনবিআরের ওয়েবসাইটেই একটি চমৎকার সহায়িকা রয়েছে। প্রথমবার ক্যালকুলেটর ব্যবহার করার আগে এটি পড়ে নিলে সহজেই প্রতিটি ধাপ বোঝা যাবে।
কতটা জনপ্রিয়
ঢাকা অফিসার্স ক্লাবে সদ্য শেষ হওয়া আয়কর মেলায় এসে ঝামেলাবিহীন ট্যাক্স ক্যালকুলেটরের ব্যবহার জেনে খুবই আনন্দিত সরকারি চাকরিজীবী বেলালউদ্দিন আহম্মেদ। জানালেন, ‘দু-তিন দিন ধরে যে হিসাব আগে করতাম, তা মাত্র আধঘণ্টায় করেছি। খুবই ভালো লাগছে।’
আয়কর মেলা ঘুরে এর জনপ্রিয়তা সহজেই বোঝা গেল। একজনের কাছ থেকে আরেকজন, তার থেকে আরো অনেকে শুনে সবাই ছুটে আসছেন মেলায় এর ব্যবহার জানতে। বিশেষ করে নতুন টিআইএনপ্রাপ্তরা এ ব্যাপারে বেশি উৎসাহী। বুথে ব্যস্ত সময় কাটানো কর্মকর্তারা আয়কর হিসাবের এ সহজতম পদ্ধতি বুঝিয়ে দিতেই হাসি ফুটে উঠছে অনেকের মুখে। সদ্য ক্যালকুলেটর থেকে আয়কর হিসাব করে প্রিন্ট আউট হাতে নতুন করদাতা নাহিদ জামান বলেন, ‘আয়কর হিসাব নিয়ে আমার রীতিমতো ভীতি ছিল। টিআইএন করার ব্যাপারটাও বেশ জটিল বলে জানতাম। কিন্তু মেলায় এসে নতুন পদ্ধতিগুলো জেনে আমি সত্যি মুগ্ধ। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় খুব দ্রুত এ কাজগুলো করে ফেললাম। ক্যালকুলেটরে ইনপুট দিতেই জানিয়ে দিল আমার নির্ধারিত কর। প্রতিটি খাতকে এভাবে প্রযুক্তির আওতায় আনা উচিত।’
সদ্য ব্যবসায় নামা তরুণ মিতুল আকবর এ ধরনের উদ্যোগ আরো বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন অস্ট্রেলিয়া ছিলাম, দেখেছি সেখানকার কর প্রদান-প্রক্রিয়া কত সহজ। সর্বোচ্চ কর আদায়ের জন্য প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারের বিকল্প নেই।’
রাজস্ব বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ট্যাক্স ক্যালকুলেটরের অনলাইন হিট বর্তমানে দুই লাখ ছাড়িয়ে গেছে, যা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। প্রায় এক বছর আগে সেবাটি চালু হলেও না জানার কারণেই বেশির ভাগ মানুষ এটি ব্যবহার করার সুযোগ পাননি। এবারের আয়কর উপলক্ষে ট্যাক্স ক্যালকুলেটর নিয়ে বিপুল প্রচারণা চালানো হয়েছে। ফলে অনেকেই এ বিষয়ে জানতে পারছেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
‘এখানেই শেষ নয়’_জানালেন প্রকল্পটির মেইনটেন্যান্স টিমের সহকারী প্রোগ্রামার মোস্তফা নুরুল ইসলাম, ‘করদাতারা যাতে সবচেয়ে কম শ্রমে আয়কর দিতে পারেন, এর জন্য আমরা চেষ্টা করছি। ট্যাক্স ক্যালকুলেটরের পাশাপাশি চালু হয়েছে ই-পেমেন্ট। ফলে নিজস্ব ডেবিট কিংবা ক্রেডিট কার্ড দিয়েই কর পরিশোধ করা যাবে।’ তাঁর কাছ থেকে আরো জানা যায়, ক্যালকুলেটরটি করদাতাদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিনিয়ত আপগ্রেড করা হবে। এ বছরের বাজেটের পর সফটওয়্যারটি একবার আপডেট করা হয়েছে, প্রতিটি বাজেটের পরই প্রয়োজনমাফিক তা করা হবে। এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সেবা প্রদানের জন্য কাজ করছে একটি দক্ষ মেইনটেন্যান্স উইং। Statuary Regulatory Order বা SRO নামক একটি কমিটির নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ প্রকল্পটি পরিচালনা করা হচ্ছে।
তবে ঢাকার বাইরের যেসব অঞ্চলে ইন্টারনেট সেবায় ঘাটতি রয়েছে, সেসব এলাকার করদাতারা এ পদ্ধতির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। প্রকল্পটি সাধারণ মানুষের ঘরে পেঁৗছে দেওয়ার জন্য ও এটি ব্যবহারে উৎসাহী করার জন্য আরো ব্যাপক প্রচারণা প্রয়োজন। সব মিলিয়ে বলা যায়, দেশের রাজস্ব খাতকে ত্বরান্বিত করার এ উদ্যোগ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য একটি বড় পদক্ষেপ। রাজস্ব বোর্ডের মতে, এর সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে পরবর্তী অর্থবছরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ করদাতা বৃদ্ধি পাবে।
Filed under: কম্পিউটার | Tagged: Bangladesh, Tax |
Leave a Reply